- বদরুদ্দীন উমর
গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় একটানাভাবে দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক অসন্তোষ ও তার পরিণতিতে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভ চলে আসছে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকার গার্মেন্টস কারখানায় বিক্ষোভ, ভাংচুর, পুলিশ ও মালিক পক্ষের গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণ ও মারধরের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়। অসহনীয় নিম্ন মজুরি এবং সে মজুরিও নিয়মিত না দেয়া এসব বিক্ষোভের মূল কারণ হলেও সাধারণভাবে এ শিল্পে শ্রমিকদের কাজের শর্ত ও অবস্থাও এ অসন্তোষ ও বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান কারণ।
সাধারণভাবে আন্দোলন অসংগঠিত ও স্বতঃস্ফূর্ত হলেও এ শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি এবং অন্য নানা দাবি-দাওয়া তারা মালিক পক্ষ ও সরকারের কাছে পেশ করে থাকেন। তবে এ ব্যাপারে সারাদেশে, এমনকি ঢাকা অঞ্চলের গার্মেন্টস কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলন ক্ষেত্রে কোন সমন্বয় নেই। এটাই স্বাভাবিক, কারণ এখানে এ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন বলতে কিছু নেই। কয়েকটি গার্মেন্টস ফেডারেশন থাকলেও প্রত্যেক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের কোন ইউনিট নেই এবং সেটা না থাকায় কোন গার্মেন্টস ফেডারেশনই যে সন্তোষজনকভাবে কাজ করতে পারে না, এটা কোন বিতর্কের বিষয় নয়। কাজেই শ্রমিকরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আন্দোলন করেন, সেক্ষেত্রে এ ফেডারেশনগুলোর ভূমিকা প্রান্তিক ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।
শাসক শ্রেণীর যে কোন সরকারই যে মূলত মালিক শ্রেণীর সরকার এবং তাদের স্বার্থ রক্ষাই সরকারের কাজ, এটা এক অবিসংবাদিত সত্য। কাজেই শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যতদূর সম্ভব মালিকদের পক্ষেই কাজ করে। এর জন্য তারা শ্রমিকদের ওপর দমনপীড়নও যথেচ্ছভাবে করে থাকে। শুধু তাই নয়, দেখা গেছে, গার্মেন্টস মালিকরা কারখানাগুলো অনুপযুক্ত ভবনে স্থাপন করায় এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রাখায় শত শত শ্রমিক বছরের পর বছর অগ্নিকাণ্ডে নিহত হলেও একের পর এক দলের সরকার সে বিষয়ে কিছুই করেনি। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার চিন্তা দীর্ঘদিন তাদের মাথায় থাকেনি। পরে কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও তার পরিমাণ অতি তুচ্ছ। তাছাড়া অনেক লাশ গুম করে দেয়ায় তাদের পরিবার সামান্য ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত থেকেছে। এই হল শ্রমিকদের প্রতি শুধু মালিকদের নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একের পর এক সরকারের আচরণ। বাংলাদেশে তিরিশ লাখের মতো গার্মেন্টস শ্রমিক আছেন, যার মধ্যে অধিকাংশই হলেন নারী। এই দরিদ্র নারী শ্রমিকদের থেকে শোষিত শ্রমিক শুধু বাংলাদেশেই নয়, দুনিয়ার কোন দেশেই নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী বা আমাদের দেশের মতোই অনুন্নত যে দেশগুলোতে গার্মেন্টস শিল্প ভালো ব্যবসা করে, তার মধ্যে পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে এই শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বাংলাদেশের শ্রমিকদের থেকে অনেক বেশি। শ্রমিকদের এই নিম্ন মজুরি অর্থাৎ অতিরিক্ত শ্রমশক্তি শোষণই হল বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের অতিরিক্ত মুনাফার কারণ, যার জন্য বাংলাদেশ সব থেকে বেশি বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প বলে প্রচারিত এবং এদেশের শাসক শ্রেণীর কাছে সব থেকে আদরণীয়। কিন্তু এ শিল্প পরিচালনা এবং উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি, স্পেয়ার পার্টস, কাপড়, সুতা, বোতাম, রঙ ইত্যাদি আমদানির জন্য যে বিদেশী মুদ্রা ব্যয় হয়, সেটা রফতানি বাবদ অর্জিত মুদ্রা থেকে বাদ দিলে দেখা যাবে, এই শিল্প থেকে অর্জিত বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ ঢাকঢোল পিটিয়ে যা বলা হয় তার থেকে অনেক কম। তবু এটা ঠিক যে, এ শিল্পই এখন বাংলাদেশে শিল্পের মধ্যে রফতানি ক্ষেত্রে সব থেকে উলে¬খযোগ্য। আগে পাট শিল্প সর্বোচ্চ বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী হলেও বিশ্বব্যাংক ও এদেশে সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাবৃন্দ সে শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে এখন তার প্রান্তিকীকরণ ঘটিয়েছে। যেহেতু গার্মেন্টস কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের জন্য খুব আবশ্যকীয়, এজন্য এ শিল্পে তাদের স্বার্থ আছে। এর উৎপাদিত পণ্য যত কম মূল্যে পাওয়া যায়, তার জন্য তাদের চেষ্টার অন্ত নেই। তাদের এ চেষ্টার সঙ্গে এই শিল্প মালিকদের স্বার্থের যোগ অবিচ্ছেদ্য। কাজেই এক্ষেত্রে তারা হাত ধরাধরি করে চলে এবং এই যুগল স্বার্থ যাতে যথাযথভাবে রক্ষিত হয়, তার জন্য মালিক স্বার্থের প্রতিনিধি এবং সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ সরকার শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের শ্রমনীতি ও শ্রম আইন প্রণয়ন করে। বাংলাদেশে এখন এভাবে নতুন শ্রমনীতি প্রণয়নের পাঁয়তারা চলছে। তবে এটাও চলছে এমনিতে নয়, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে বিরাজমান অসন্তোষ এবং সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখে।
সরকারের এই শিল্পনীতি বলতে প্রধানত বোঝায় শ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণ। কিন্তু এক্ষেত্রে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠা, প্রত্যেক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শ্রমিক-মালিক দরকষাকষির সুষ্ঠু ব্যবস্থা, ধর্মঘটের অধিকার, দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিতে মজুরির বাৎসরিক পর্যালোচনা ও পুনর্নির্ধারণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকারের শিল্পনীতিতে বিশেষ অথবা কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায় না।
যদিও এদেশে ট্রেড ইউনিয়নগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। তাদের মধ্যে মালিক ও সরকারি দালালদের উপস্থিতি শ্রমিকদের জন্য প্রায়ই ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তা সত্ত্বেও ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া শ্রমিক ও মালিক পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ও দরকষাকষির অন্য কোন কার্যকর ব্যবস্থা শিল্পক্ষেত্রে নেই। বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রে, বিশেষত সরকার পরিচালিত শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন যেভাবে কাজ করে, সেটা খুবই অসন্তোষজনক হলেও গার্মেন্টস শিল্পে তারও কোন নামগন্ধ দেখা যায় না। এ শিল্পে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কোন নিয়ম-কানুনই মেনে চলা হয় না। সরকারই এসব ক্ষেত্রে মালিকদের রেয়াত দিয়ে রেখেছে।
এ বছরের প্রথম থেকেই আশুলিয়া, কাঁচপুর, মিরপুর, সাভার ইত্যাদি ঢাকা অঞ্চলের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ চলে আসছে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া ন্যায়সঙ্গত হলেও তা মেটানোর চেষ্টা মালিক ও সরকারের পক্ষে দেখা যায়নি। তবে এ পরিস্থিতির একটা বড় রকম চাপ তাদের উভয়ের ওপর আছে। এ কারণে শ্রমিকদের সঙ্গে নয়, মালিকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সরকার সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টায় আছে। এই চেষ্টার সব থেকে উলে¬খযোগ্য দিক যেখানে হওয়া দরকার এ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার প্রদান এবং ট্রেড ইউনিয়ন কার্যপ্রক্রিয়া যাতে শুরু হয়, তার ব্যবস্থা করা হলেও সরকার এর ধারেকাছেও নেই। তাদের গার্মেন্টস শিল্পনীতির মূল দিক হল মজুরি সামান্য বৃদ্ধি, যা শ্রমিকদের সঙ্গে নয়, মালিকদের সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে। শুধু এ বিষয়টি যে মালিকদের সঙ্গে পরামর্শ করে হচ্ছে তা-ই নয়, মালিকদের চাপে এখন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তাদের সরকার ট্রেড ইউনিয়ন নয়, শিল্প পুলিশের ব্যবস্থা করছে। মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এ মাসের শেষদিকে সরকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু যে মজুরি তারা ঘোষণা করবেন তার আভাস থেকে বোঝা যাচ্ছে, তার দ্বারা এই শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ হওয়ার নয়। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র, তাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার কোন ব্যবস্থা সরকারের নতুন শ্রমনীতির মধ্যে থাকার কোন কথাই শোনা যাচ্ছে না। এসব দ্বারা নতুন করে প্রমাণ হবে সরকার মালিকদেরই, শ্রমিকদের কেউ নয়।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ১১/০৭/১০]
গার্মেন্টস শিল্প এলাকায় একটানাভাবে দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিক অসন্তোষ ও তার পরিণতিতে ব্যাপক শ্রমিক বিক্ষোভ চলে আসছে। প্রায় প্রতিদিনই কোন না কোন এলাকার গার্মেন্টস কারখানায় বিক্ষোভ, ভাংচুর, পুলিশ ও মালিক পক্ষের গুণ্ডাবাহিনীর আক্রমণ ও মারধরের খবর সংবাদপত্রে ছাপা হয়। অসহনীয় নিম্ন মজুরি এবং সে মজুরিও নিয়মিত না দেয়া এসব বিক্ষোভের মূল কারণ হলেও সাধারণভাবে এ শিল্পে শ্রমিকদের কাজের শর্ত ও অবস্থাও এ অসন্তোষ ও বিক্ষোভের অন্যতম প্রধান কারণ।

সাধারণভাবে আন্দোলন অসংগঠিত ও স্বতঃস্ফূর্ত হলেও এ শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিকদের মজুরি এবং অন্য নানা দাবি-দাওয়া তারা মালিক পক্ষ ও সরকারের কাছে পেশ করে থাকেন। তবে এ ব্যাপারে সারাদেশে, এমনকি ঢাকা অঞ্চলের গার্মেন্টস কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে আন্দোলন ক্ষেত্রে কোন সমন্বয় নেই। এটাই স্বাভাবিক, কারণ এখানে এ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন বলতে কিছু নেই। কয়েকটি গার্মেন্টস ফেডারেশন থাকলেও প্রত্যেক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়নের কোন ইউনিট নেই এবং সেটা না থাকায় কোন গার্মেন্টস ফেডারেশনই যে সন্তোষজনকভাবে কাজ করতে পারে না, এটা কোন বিতর্কের বিষয় নয়। কাজেই শ্রমিকরা বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আন্দোলন করেন, সেক্ষেত্রে এ ফেডারেশনগুলোর ভূমিকা প্রান্তিক ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না।
শাসক শ্রেণীর যে কোন সরকারই যে মূলত মালিক শ্রেণীর সরকার এবং তাদের স্বার্থ রক্ষাই সরকারের কাজ, এটা এক অবিসংবাদিত সত্য। কাজেই শ্রমিকদের দাবি-দাওয়ার ক্ষেত্রে সরকার যতদূর সম্ভব মালিকদের পক্ষেই কাজ করে। এর জন্য তারা শ্রমিকদের ওপর দমনপীড়নও যথেচ্ছভাবে করে থাকে। শুধু তাই নয়, দেখা গেছে, গার্মেন্টস মালিকরা কারখানাগুলো অনুপযুক্ত ভবনে স্থাপন করায় এবং প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রাখায় শত শত শ্রমিক বছরের পর বছর অগ্নিকাণ্ডে নিহত হলেও একের পর এক দলের সরকার সে বিষয়ে কিছুই করেনি। নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়ার চিন্তা দীর্ঘদিন তাদের মাথায় থাকেনি। পরে কোন কোন ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও তার পরিমাণ অতি তুচ্ছ। তাছাড়া অনেক লাশ গুম করে দেয়ায় তাদের পরিবার সামান্য ক্ষতিপূরণ থেকেও বঞ্চিত থেকেছে। এই হল শ্রমিকদের প্রতি শুধু মালিকদের নয়, জনগণের ভোটে নির্বাচিত একের পর এক সরকারের আচরণ। বাংলাদেশে তিরিশ লাখের মতো গার্মেন্টস শ্রমিক আছেন, যার মধ্যে অধিকাংশই হলেন নারী। এই দরিদ্র নারী শ্রমিকদের থেকে শোষিত শ্রমিক শুধু বাংলাদেশেই নয়, দুনিয়ার কোন দেশেই নেই। আমাদের পার্শ্ববর্তী বা আমাদের দেশের মতোই অনুন্নত যে দেশগুলোতে গার্মেন্টস শিল্প ভালো ব্যবসা করে, তার মধ্যে পাকিস্তান, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশে এই শিল্প শ্রমিকদের মজুরি বাংলাদেশের শ্রমিকদের থেকে অনেক বেশি। শ্রমিকদের এই নিম্ন মজুরি অর্থাৎ অতিরিক্ত শ্রমশক্তি শোষণই হল বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের অতিরিক্ত মুনাফার কারণ, যার জন্য বাংলাদেশ সব থেকে বেশি বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী শিল্প বলে প্রচারিত এবং এদেশের শাসক শ্রেণীর কাছে সব থেকে আদরণীয়। কিন্তু এ শিল্প পরিচালনা এবং উৎপাদনের জন্য যন্ত্রপাতি, স্পেয়ার পার্টস, কাপড়, সুতা, বোতাম, রঙ ইত্যাদি আমদানির জন্য যে বিদেশী মুদ্রা ব্যয় হয়, সেটা রফতানি বাবদ অর্জিত মুদ্রা থেকে বাদ দিলে দেখা যাবে, এই শিল্প থেকে অর্জিত বিদেশী মুদ্রার পরিমাণ ঢাকঢোল পিটিয়ে যা বলা হয় তার থেকে অনেক কম। তবু এটা ঠিক যে, এ শিল্পই এখন বাংলাদেশে শিল্পের মধ্যে রফতানি ক্ষেত্রে সব থেকে উলে¬খযোগ্য। আগে পাট শিল্প সর্বোচ্চ বিদেশী মুদ্রা অর্জনকারী হলেও বিশ্বব্যাংক ও এদেশে সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহক রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও আমলাবৃন্দ সে শিল্পকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করে এখন তার প্রান্তিকীকরণ ঘটিয়েছে। যেহেতু গার্মেন্টস কারখানায় উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের জন্য খুব আবশ্যকীয়, এজন্য এ শিল্পে তাদের স্বার্থ আছে। এর উৎপাদিত পণ্য যত কম মূল্যে পাওয়া যায়, তার জন্য তাদের চেষ্টার অন্ত নেই। তাদের এ চেষ্টার সঙ্গে এই শিল্প মালিকদের স্বার্থের যোগ অবিচ্ছেদ্য। কাজেই এক্ষেত্রে তারা হাত ধরাধরি করে চলে এবং এই যুগল স্বার্থ যাতে যথাযথভাবে রক্ষিত হয়, তার জন্য মালিক স্বার্থের প্রতিনিধি এবং সাম্রাজ্যবাদের বশংবদ সরকার শ্রমিকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের শ্রমনীতি ও শ্রম আইন প্রণয়ন করে। বাংলাদেশে এখন এভাবে নতুন শ্রমনীতি প্রণয়নের পাঁয়তারা চলছে। তবে এটাও চলছে এমনিতে নয়, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে গার্মেন্টস শিল্প শ্রমিকদের মধ্যে বিরাজমান অসন্তোষ এবং সাম্প্রতিক বিক্ষোভ ও আন্দোলনের মুখে।
সরকারের এই শিল্পনীতি বলতে প্রধানত বোঝায় শ্রমিকদের মজুরি পুনর্নির্ধারণ। কিন্তু এক্ষেত্রে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার প্রতিষ্ঠা, প্রত্যেক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, শ্রমিক-মালিক দরকষাকষির সুষ্ঠু ব্যবস্থা, ধর্মঘটের অধিকার, দেশের বর্তমান মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির পরিস্থিতিতে মজুরির বাৎসরিক পর্যালোচনা ও পুনর্নির্ধারণ ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকারের শিল্পনীতিতে বিশেষ অথবা কোন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পায় না।
যদিও এদেশে ট্রেড ইউনিয়নগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। তাদের মধ্যে মালিক ও সরকারি দালালদের উপস্থিতি শ্রমিকদের জন্য প্রায়ই ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়, তা সত্ত্বেও ট্রেড ইউনিয়ন ছাড়া শ্রমিক ও মালিক পক্ষের মধ্যে আনুষ্ঠানিক যোগাযোগ ও দরকষাকষির অন্য কোন কার্যকর ব্যবস্থা শিল্পক্ষেত্রে নেই। বাংলাদেশের অন্যান্য শিল্পক্ষেত্রে, বিশেষত সরকার পরিচালিত শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন যেভাবে কাজ করে, সেটা খুবই অসন্তোষজনক হলেও গার্মেন্টস শিল্পে তারও কোন নামগন্ধ দেখা যায় না। এ শিল্পে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) কোন নিয়ম-কানুনই মেনে চলা হয় না। সরকারই এসব ক্ষেত্রে মালিকদের রেয়াত দিয়ে রেখেছে।
এ বছরের প্রথম থেকেই আশুলিয়া, কাঁচপুর, মিরপুর, সাভার ইত্যাদি ঢাকা অঞ্চলের গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে ব্যাপক শ্রমিক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ চলে আসছে। এক্ষেত্রে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া ন্যায়সঙ্গত হলেও তা মেটানোর চেষ্টা মালিক ও সরকারের পক্ষে দেখা যায়নি। তবে এ পরিস্থিতির একটা বড় রকম চাপ তাদের উভয়ের ওপর আছে। এ কারণে শ্রমিকদের সঙ্গে নয়, মালিকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে সরকার সমস্যা মোকাবেলার চেষ্টায় আছে। এই চেষ্টার সব থেকে উলে¬খযোগ্য দিক যেখানে হওয়া দরকার এ শিল্পে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের অধিকার প্রদান এবং ট্রেড ইউনিয়ন কার্যপ্রক্রিয়া যাতে শুরু হয়, তার ব্যবস্থা করা হলেও সরকার এর ধারেকাছেও নেই। তাদের গার্মেন্টস শিল্পনীতির মূল দিক হল মজুরি সামান্য বৃদ্ধি, যা শ্রমিকদের সঙ্গে নয়, মালিকদের সঙ্গে কথাবার্তার মাধ্যমে নির্ধারিত হচ্ছে। শুধু এ বিষয়টি যে মালিকদের সঙ্গে পরামর্শ করে হচ্ছে তা-ই নয়, মালিকদের চাপে এখন পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য তাদের সরকার ট্রেড ইউনিয়ন নয়, শিল্প পুলিশের ব্যবস্থা করছে। মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে বলে অর্থমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।
এ মাসের শেষদিকে সরকার গার্মেন্টস শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি ঘোষণা করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু যে মজুরি তারা ঘোষণা করবেন তার আভাস থেকে বোঝা যাচ্ছে, তার দ্বারা এই শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ বন্ধ হওয়ার নয়। শুধু তাই নয়, শ্রমিকদের জন্য নিয়োগপত্র, তাদের অন্যান্য প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার কোন ব্যবস্থা সরকারের নতুন শ্রমনীতির মধ্যে থাকার কোন কথাই শোনা যাচ্ছে না। এসব দ্বারা নতুন করে প্রমাণ হবে সরকার মালিকদেরই, শ্রমিকদের কেউ নয়।
[সূত্রঃ যুগান্তর, ১১/০৭/১০]
If you liked the post then,
Click here to Join us for FREE email updates from "www.apparelmakers.org", so that you do not miss out anything that can be valuable to you and your business!!
0 comments:
Post a Comment